বিশেষ করে রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় রোগী ভর্তি হওয়ার চাপ বাড়ছে। রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। শয্যা না পেয়ে অনেকেই মেঝেতেও নিচ্ছেন চিকিৎসা। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা চলতি বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুও রেকর্ড। সব মিলিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়াল। আর মৃতদের মধ্যে শূন্য থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে রয়েছে ৪৫ শতাংশ।
মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৩৪ জন। এর আগের দিন সোমবার একজনের মৃত্যু এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬১৫ জন। যা এ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা। সব মিলিয়ে এ মাসের ১০ দিনে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছে ৩ হাজার ৯৭৮ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪শ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর আগের মাস আগস্টে মৃত্যু হয়েছিল ২৭ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬ হাজার ৫২১ জন। অথচ গত ১০ দিনেই অর্ধেকের বেশি রোগী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
সেপ্টেম্বরের শেষে এবং সামনের মাসগুলোতে দেশে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি আরো খারাপের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, থেমে থেমে বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতার কারণে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলররা না থাকায় মশা নিধন কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে। নিয়মিতভাবে কাজ করছে না মশক নিধন কর্মীরা। অভিযান পরিচালনা কার্যক্রম থেমে গেছে। এ ছাড়া লার্ভিসাইড স্প্রে এবং ফগিংসহ সিটি করপোরেশনের নিয়মিত মশাবিরোধী ব্যবস্থাগুলোও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে ডেঙ্গুর মৌসুম হওয়ায় রাজধানীসহ সারা দেশে মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বিগত কয়েক বছরের পর্যালোচনায় দেখা গেছে-বর্ষার মূল মৌসুমের পরে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করে। আর ডেঙ্গু শুধু এখন ঢাকাকেন্দ্রিক নয়, বরং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। সুতরাং ডেঙ্গু প্রতিরোধে কারিগরিভাবে সঠিক ও বাস্তবায়নযোগ্য একটি কর্মকৌশল দ্রুত প্রণয়ন করা জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছে ১০২ জনের। আর এ বছর মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার ৮১৯ জন। অথচ গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে এই সময়ে মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ১৪ জনের। আর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩২৮ জন। অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে এ বছর মৃতের সংখ্যা ৭ গুণ বেশি। যদিও আক্রান্তের নয়গুণ কম।
চলতি বছর চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে ১০২ জনের মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে ৬৬ জনই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। তবে সবচেয়ে বেশি ৫৮ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৭১ শতাংশই মৃত্যুই ঘটেছে ঢাকায়। আর ঢাকার দুই সিটিতে এবার মোট আক্রান্ত হয়েছে ৬ হাজার ৭৬৭ জন। আর আক্রান্তের হার হচ্ছে ৪০ দশমিক ২৪ শতাংশ। এর বাইরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে বিভাগে ১২ জন এবং বরিশাল বিভাগে ১০ জন। তবে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন চট্টগ্রামে বিভাগে ৩ হাজার ৩০৯ জন। এ ছাড়া চলতি বছরের মৃতদের মধ্যে ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সিরা সবচেয়ে বেশি ১১ শতাংশ। এরপরই ১০ শতাংশের বয়স হচ্ছে ৬ থেকে ১০ বছর এবং ২৬ থেকে ৩০ বছর ও ৪৬ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে রয়েছে ৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্তের রেকর্ড। যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সবশেষ তথ্যে জানা গেছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ১ হাজার ৬৪২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি ৯১৭ জন এবং ঢাকার বাইরে রয়েছেন ৭২৫ জন। এ ছাড়া চলতি বছরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট চিকিৎসা নিয়েছেন ৮৬৬ জন। আর বর্তমানে মোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন ১১৬ জন। এরপরই মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী ১ হাজার ৬৩০ জন ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। আর বর্তমানে রোগী ভর্তি রয়েছে ৬২ জন। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু চট্টগ্রাম বিভাগে।
হাসপাতালে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দিন দিন রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর রোগীর চাপ বাড়ছে। এমনকি ঢাকার বাইরে থেকে আসতে শুরু করেছে রোগী, যাদের অধিকাংশই জটিল শারীরিক সমস্যা নিয়ে আসছেন। আবার অনেক রোগী এমন জটিল পর্যায়ে হাসপাতালে আসছেন, যখন আর চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকে না। প্রত্যেকের অবস্থা জটিল হওয়ায় ভর্তি হচ্ছেন এবং ভর্তি হওয়া রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন থাকে না, ব্লাড প্রেশার রেকর্ড করা যায় না।
এ ব্যাপারে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাসিবুল ইসলাম বলেন, এ মাসের শুরু থেকে হাসপাতালে রোগীর চাপ কিছুটা বেড়েছে। সামনের দিনগুলোতে হয়তো আরও রোগীর চাপ বাড়তে পারে। তাই রোগী ও স্বজনদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
ডা. হাসিবুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু থেকে রক্ষার প্রধান উপায় হচ্ছে নিজের বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। শুধু নিজে নয় বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে।
সূত্র: bnanews24