বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার পালিত হয় বিশ্ব দৃষ্টি দিবস (World Sight Day)। এ দিবসটি শুধু অন্ধত্ব প্রতিরোধ বা চক্ষু রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়, বরং জনসচেতনতা বৃদ্ধি, দৃষ্টি শক্তি রক্ষায় বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগ, এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতীক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ২.২ বিলিয়ন মানুষ দৃষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগছে, যার অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য বা চিকিৎসাযোগ্য অন্ধত্ব বিদ্যমান। এ বাস্তবতায়, বিশ্ব দৃষ্টি দিবস ২০২৫-এ বাংলাদেশে অপটোমেট্রিস্টদের ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও International Agency for the Prevention of Blindness (IAPB) বারবার জোর দিয়ে বলেছে, অন্ধত্ব প্রতিরোধে প্রাথমিক চোখের যত্ন (Primary Eye Care) এবং দক্ষ মানবসম্পদ অপরিহার্য। উন্নত দেশগুলো যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা সিঙ্গাপুরে অপটোমেট্রিস্টরা প্রাথমিক চোখের সেবার মূল চালিকাশক্তি। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ায় অপটোমেট্রিস্টরা প্রাথমিক পর্যায়ে চক্ষু পরীক্ষার পাশাপাশি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি স্ক্রিনিং, গ্লুকোমা শনাক্তকরণ, এমনকি টেলি-অপটোমেট্রির মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় বিশেষায়িত সেবা প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্রে অপটোমেট্রিস্টদেরকে ‘Frontline Eye Care Provider’ বলা হয়, কারণ তারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই দৃষ্টি সমস্যা নির্ণয় ও চিকিৎসা দিতে সক্ষম। এর ফলে সেখানে অন্ধত্বের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বিশ্বব্যাপী “Vision 2020: The Right to Sight” কর্মসূচির মূল শক্তি ছিল প্রশিক্ষিত চক্ষু পেশাজীবী তৈরি করা।
আফ্রিকার দেশগুলোতেও স্থানীয় পর্যায়ে Community Optometry চালু করে সফলতা এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, ঘানায় অপটোমেট্রি আইনগত স্বীকৃতি পাওয়ার পর সেখানে প্রতিরোধযোগ্য অন্ধত্বের হার ৩০% কমে যায় (WHO, 2022)। ফলে স্পষ্ট যে, বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা অনুযায়ী অপটোমেট্রিস্টরা অন্ধত্ব প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ বিভিন্ন দৃষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগছে (National Eye Care, DGHS, 2023)। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ হলো রিফ্র্যাক্টিভ এরর, ক্যাটারাক্ট, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ও গ্লুকোমা। সরকার “জাতীয় চক্ষু যত্ন কর্মসূচি” চালু করলেও দেশে দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি প্রকট। বর্তমানে বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চোখের সেবা প্রদান করেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ (Ophthalmologist) ও ভিশন টেকনিশিয়ানরা। তবে WHO এর Human Resources for Eye Health গাইডলাইনে উল্লেখ আছে যে, একটি দেশে চোখের সেবার জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ টিম প্রয়োজন যেখানে অপটোমেট্রিস্টের ভূমিকা অপরিহার্য।
বাংলাদেশে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যেমন CMU, RMU) অপটোমেট্রি শিক্ষা চালু হলেও পেশার আইনগত স্বীকৃতি এখনো নেই। ফলে ডিগ্রিধারী অপটোমেট্রিস্টরা তাদের পূর্ণ দক্ষতা প্রয়োগ করতে পারছেন না। অথচ প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যেই অপটোমেট্রিকে আইনগতভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। দৃষ্টি সমস্যার প্রাথমিক সনাক্তকরণ: বাংলাদেশে প্রতি ৪ জন শিশুর মধ্যে ১ জন স্কুলে দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছে (BRAC Health Report, 2022)। দক্ষ অপটোমেট্রিস্ট থাকলে স্কুল-ভিত্তিক স্ক্রিনিং কার্যক্রম জোরদার করা সম্ভব। চোখের রোগের প্রতিরোধ: ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ও গ্লুকোমার মতো নীরব রোগ প্রাথমিকভাবে অপটোমেট্রিস্টরা শনাক্ত করতে পারে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৮.৪ মিলিয়ন ডায়াবেটিক রোগী রয়েছে (IDF, 2024)।শহরকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় গ্রামের মানুষরা প্রায়ই চোখের বিশেষায়িত সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। আইনগত স্বীকৃতি পেলে কমিউনিটি অপটোমেট্রিস্টরা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজ করতে পারবেন। জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান: Vision Loss Productivity Report (2021) অনুযায়ী, দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। দক্ষ অপটোমেট্রি সেবা এই ক্ষতি কমাতে সাহায্য করবে। আন্তর্জাতিক মান রক্ষা: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া অধিকাংশ দেশ ইতিমধ্যেই অপটোমেট্রি আইনগতভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বাংলাদেশেরও এই পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি যাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও স্বাস্থ্যসেবা মান বজায় থাকে। অপটোমেট্রিস্টরা কেবলমাত্র চশমা প্রেসক্রাইব করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তারা—কনট্যাক্ট লেন্স ও অর্থোকেরাটোলজি ব্যবস্থাপনা, লো ভিশন ও রিহ্যাবিলিটেশন সেবা, পাবলিক হেলথ রিসার্চ ও এপিডেমিওলজিক্যাল সার্ভে, টেলি-অপটোমেট্রি ও ডিজিটাল হেলথ ইনোভেশন, স্কুল ও কমিউনিটি বেসড ভিশন স্ক্রিনিং, চক্ষু রোগের প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও রেফারেল সিস্টেম, এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের দৃষ্টি স্বাস্থ্য খাত নতুন মাত্রা পাবে। ২০২৫ সালের বিশ্ব দৃষ্টি দিবসের মূল বার্তা হলো, “Love Your Eyes at Work”— কাজের জায়গায় চোখের সুরক্ষা।
এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে তৈরি হতে পারে কর্মক্ষেত্রভিত্তিক চোখের স্বাস্থ্য প্রোগ্রাম, যেখানে অপটোমেট্রিস্টরা শিল্প কারখানা, গার্মেন্টস, তথ্য প্রযুক্তি খাতে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করতে পারবেন। গার্মেন্টস খাতে প্রায় ৪ মিলিয়ন শ্রমিক কাজ করছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ দৃষ্টি সমস্যায় ভুগছেন। এছাড়া, আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন ORBIS International, Vision 2020, IAPB ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কাজ করছে।
এ সংস্থাগুলো বারবার সুপারিশ করছে বাংলাদেশে অপটোমেট্রি পেশার আইনগত স্বীকৃতি প্রদানের জন্য। বিশ্ব দৃষ্টি দিবস ২০২৫ আমাদের সামনে এক নতুন বার্তা দিচ্ছে— চোখের সেবা শুধুমাত্র চিকিৎসকের সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং একটি সমন্বিত টিমওয়ার্ক প্রয়োজন যেখানে অপটোমেট্রিস্টরা মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশে যদি দ্রুত অপটোমেট্রি পেশার আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করা হয়, তবে কেবল জাতীয় পর্যায়েই নয়, আন্তর্জাতিক দৃষ্টি স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারবে। একটি দৃষ্টিশক্তি-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের জন্য এখনই সময়— অপটোমেট্রিস্টদেরকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্য কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করার।
-ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সহকারী অধ্যাপক এবং রিসার্চ ফেলো ম্যানেজমেন্ট এন্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি,