প্রতি বছরই আমাদের মুসলিম সমাজে ঈদুল আজহার সময় আসে আনন্দ ও ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে দিয়ে। এ উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো কোরবানি। কোরবানি মানে শুধু প্রাণী জবাই করে মাংস খাওয়া নয়, এর পেছনে রয়েছে গভীর অর্থ ও মানবিক দায়িত্ব।
কুরবানিকে আরবি ভাষায় ‘উযহিয়্যা’ বলা হয়। ‘উযহিয়্যা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ওই পশু যা কুরবানির দিন জবাই করা হয়।
শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহতাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে কুরবানি বলে।কোরবানির ইতিহাস আমাদের জানায়, হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁর এ ত্যাগের পরীক্ষা গ্রহণ করে তাঁকে জান্নাতি দুম্বা কোরবানি করতে বলেছিলেন। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের শেখানো হয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয় জিনিস ত্যাগ করার শিক্ষা।
ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। এই দিনটি আল্লাহর প্রতি আস্থা, আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতার প্রতীক। কোরবানির মাধ্যমে মুসলিমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি দেন। কিন্তু কোরবানির মূল উদ্দেশ্য কি শুধুই গোশত খাওয়া? অবশ্যই নয়। কোরবানির প্রকৃত মর্মবাণী হলো সকলের হক আদায় করা এবং আল্লাহর নির্দেশ পালন করা।
কোরবানির মর্মার্থ :
১. ত্যাগের প্রতীক: কোরবানি মূলত ত্যাগের প্রতীক। এটি হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তার পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) এর ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে পালন করা হয়। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে তার পুত্রকে কোরবানি দিতে চেয়েছিলেন, যা আল্লাহর প্রতি তার চরম আনুগত্য ও ত্যাগের নিদর্শন।
২. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন: কোরবানির মুল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এটি একটি ইবাদত যা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম। মাংসের ভাগাভাগি এবং দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা হয়।
৩. সমাজের প্রতি দায়িত্ব: কোরবানির মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারি। কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করা হয়: এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের জন্য, এবং এক ভাগ দরিদ্র ও অভাবীদের জন্য।
সবার হক আদায়
কোরবানি শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি সামাজিক ও মানবিক দায়িত্বও বহন করে। তাই আমাদের উচিত কোরবানি দিয়ে শুধু মাংস ভোগ না করে এর মূল শিক্ষা অনুসরণ করা:
প্রথমত, কোরবানির পশুর গোশত শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে ভাগ করা উচিত নয়। কোরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ নিজেদের জন্য, একভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং একভাগ গরীব ও অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করা উচিত। এতে সমাজে সমবন্টন এবং সহমর্মিতার মানসিকতা সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয়ত, কোরবানি একটি আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়। আমরা যখন আমাদের প্রিয় কিছু আল্লাহর পথে ত্যাগ করি, তখন তা আমাদের মন-মানসিকতা ও আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। এটি আমাদেরকে দানশীল ও উদার হতে শেখায়।
তৃতীয়ত, কোরবানির পশু ক্রয় এবং যত্ন নেওয়া একটি গুরুতর দায়িত্ব। কোরবানির পশুর স্বাস্থ্য ও ভালো থাকা নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য। এটি শুধুমাত্র আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, এটি পশুর প্রতি আমাদের নৈতিক দায়িত্বও বটে।
এছাড়া, কোরবানি দেওয়ার পর আমরা যেন পরিবেশের সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে গোশত প্রক্রিয়াকরণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এতে আমরা একটি সুন্দর এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারি।
আবার, আমাদের সমাজে দেখা যায় অনেকেই বাজারের সবচাইতে সেরা গরুটি কেনার জন্য প্রতিযোগিতায় নামেন। আবার কেউ কেউ সুনাম কুড়ানোর জন্য বেশী দামের গরু, উট বা মহিষ কুরবানী করেন। অনেকে সামর্থ না থাকা সত্ত্বেও ‘নতুন জামাই কি বলবে” বা ‘এতদিন কোরবানী দিয়ে এসেছি এখন না দিলে লোকে কি বলবে” ইত্যাদি কারণে অনেকে কুরবানী করে থাকেন। কোরবানীর পশু যদি সুস্থ সবল হয়, বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত হয় এবং তা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরীয়াহ সম্মাতভাবে করা হয় তাহলে তা আল্লাহ তা‘আলার নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। লোক দেখানোর জন্য বা সুনামের জন্য বেশী দামের পশু কেনা। উট, মহিষ ইত্যাদি বড় বড় পশু কোরবানী করা, অথবা লোকজনকে দেখানোর জন্য কুরবানীর পশু লাল কাপড় ও মালা দিয়ে সাজানো, কুরবানীর পশুকে প্রদর্শনীর উদ্দেশে খোলা স্থানে বেঁধে রাখা ইত্যাদি কোনক্রমেই শরীয়তসম্মত নয় এবং তা আল্লাহ তায়ালার নিকট কবুলকৃত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ আল্লাহ তায়ালা শুধুমাত্র মানুষের অন্তরের মধ্যে ইখলাছ ও তাকওয়া দেখতে আগ্রহী। কোন কোরবানীর পশুতে কত মন মাংস হয়েছে বা কত রক্ত প্রবাহিত হয়েছে বা কোন পশুটিতে বেশী চর্বি হয়েছে, কোনটির শিং কত বড় ইত্যাদি মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকট বিবেচ্য নয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তা‘আলার কাছে এদের মাংস ও রক্ত কিছুই পৌছবে না, তাঁর নিকট শুধুমাত্র তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছবে।” [সূরা নং ২২ (আল-হাজ্জ্ব), আয়াতঃ ৩৭] তাই সুস্থ সবল ও ত্রুটিমুক্ত কুরবানীর পশু ক্রয় করতে হবে। সাথে সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে এ ক্ষেত্রে যেন ‘রিয়া’ বা প্রদর্শনেচ্ছা না থাকে। কারণ মানুষের মধ্যে সে ব্যক্তিই সর্বোত্তম যিনি সবচাইতে বেশী তাকওয়াবান। সুতরাং লোক দেখানো ও গতানুগতিকতা পরিহার করে ইখলাছ ও তাকওয়ার মহিমায় উজ্জীবীত হয়ে কুরবানী করা উচিত যাতে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ) এর মত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে যে কোন ধরনের ত্যাগ শিকারে কোন মুসলিম পিছপা না হয়।
তাই, কোরবানি দেওয়ার সময় শুধু মাংসের জন্যই না, আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং সমাজের সকলের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করা। ঈদুল আজহা আমাদের শিখায়, কিভাবে আমরা ত্যাগ ও সহানুভূতির মাধ্যমে আমাদের জীবনকে আলোকিত করতে পারি এবং সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনতে পারি।
সর্বোপরি, কোরবানির আসল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা, নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা এবং সমাজের দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করা। তাই, আসুন আমরা সবাই মিলে এই ঈদুল আজহায় কোরবানির প্রকৃত মর্মবাণী ধারণ করি এবং সবার হক আদায় করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমিন।
ডক্টর মোঃ মিজানুর রহমান , পিএইচডি , দৃষ্টি বিজ্ঞান
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট এন্ড সাইন্স ইউনিভার্সিটি , মালয়েশিয়া